1. editor@kalpataru.tv : বার্তা বিভাগ : বার্তা বিভাগ
  2. kalpataru.org.bd@gmail.com : Rajib Barua Raju : Rajib Barua Raju
  3. admin@kalpataru.tv : admin :
শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩১ পূর্বাহ্ন

সিদ্ধার্থ থেকে মহাকারুনিক গৌতম বুদ্ধ হওয়ার ইতিহাস

লাবনী বড়ুয়া
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫
  • ১৮৪ বার পঠিত

রাজা শুদ্ধোধনের মনে একইসাথে আনন্দ আর দুশ্চিন্তা বিরাজ করছে। আনন্দের কারণ তিনি সন্তানের বাবা হতে চলেছেন, আর দুশ্চিন্তার কারণ এই সময় স্ত্রীর পাশে তিনি থাকতে পারছেন না। রানী মায়াদেবী রাজবহর নিয়ে তার পিত্রালয় দেবদাহের পথে যাত্রা করেন। ঐতিহ্যগতভাবে নারীদের প্রথম সন্তান প্রসব করতে হয় পিত্রালয়ে। মায়াদেবীর অন্তরও স্বামী শুদ্ধোধনের মতো একই কারণে আনন্দিত আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। রানীর কেবলই মনে হচ্ছে, এই পথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

সময় ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, (বর্তমান নেপালের) কপিলাবস্তুর লুম্বীনির শালবনের বিশ্রাম শিবিরে মায়াদেবী শুয়ে আছেন। রাতের বেলাও চারদিক আলোকোজ্জ্বল। আকাশে বৈশাখী পূর্ণিমার চাঁদ জোৎস্না বিলিয়ে যাচ্ছে অকৃপণ মমতায়। রানীর পাশে সদ্যোজাত শিশু হাত, পা নেড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। রানীর মনে হচ্ছে, চারদিকে এত আলো, এত আনন্দের উৎস চাঁদ নয়, ফুটফুটে শিশুটি।

মায়াদেবী পিত্রালয়ে না গিয়ে সন্তানসহ রাজপ্রাসাদে চলে এলেন। নবজাতকের নাম দেয়া হয়েছে সিদ্ধার্থ, যার অর্থ ‘সিদ্ধি লাভ করেছেন যিনি’। শুদ্ধোধন আগের মতোই আনন্দিত আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। রাজজ্যোতিষী অসিত সিদ্ধার্থের শরীরে বত্রিশটি সুলক্ষণ চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন, নিঃসন্দেহে এটি আনন্দের সংবাদ। সাথে আরো বলেছেন, এই বালকের রাজ্য শাসন থেকে জ্ঞান চর্চায় ঝোঁক বেশি থাকবে, এই বক্তব্য আনন্দের কি না তিনি বুঝতে পারছেন না। তবে এই বালক একদিন মানবতার মুক্তির জন্য গৃহত্যাগী হবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাজা যারপরনাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

Image Courtesy: Lumbini – BOA Overland

রাজার দুশ্চিন্তার অবসান তো হচ্ছেই না, বরং আরো বাড়ল। সন্তান জন্মদানের সাতদিনের মাথায় রানী ইহলোক ত্যাগ করলেন। স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি ভেঙে পড়লেন, সাথে সাথে এই বাচ্চাকে উপযুক্ত করে বড় করতে যে মাতৃস্নেহের বিকল্প নেই, সেটাও বুঝতে পারছেন, কিন্তু সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না। সমাধান এলো রাজার শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে। মায়াদেবীর ছোট বোন কুমারী মহাপ্রজাপতিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হলো শুদ্ধোধনের কাছে। মাতৃহারা সিদ্ধার্থ এতদিন মাসীর তত্ত্বাবধানেই ছিলেন, এখন সেটা পাকাপোক্ত করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সিদ্ধার্থের দিকে চেয়ে রাজা মানা করতে পারলেন না।

ছোট্ট সিদ্ধার্থ ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, শাস্ত্র, খেলাধুলা, যুদ্ধবিদ্যা, শিল্পকলা সবকিছুতেই পারদর্শী হয়ে উঠছে। রাজপুত্রের প্রতিভায় রাজা আনন্দিত। সাথে সাথে এটাও খেয়াল করছেন, জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়ে যাচ্ছে, তার দুশ্চিন্তা- এই ছেলে রাজ্যশাসনের ভার নেবে তো?

রাজপুত্রকে সংসারের জালে বাধতে রাজা নানা কায়দা-কানুন তৈরি করেছেন। রাজপুত্র পারতপক্ষে রাজপ্রাসাদের বাইরে যেন না যায় সেই ব্যবস্থা করেছেন। তার জন্য কয়েকটি প্রাসাদও তৈরি করা হয়েছে, সবগুলোই বিলাস-উপকরণে পরিপূর্ণ, এমনকি এক প্রাসাদ থেকে অন্য প্রাসাদে যাওয়ার পথও সকল ‘অশুভ, অমঙ্গল, অসুন্দর’ মুক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি প্রাসাদে পদ্মপুকুরসমেত বিশ্রামাগার আছে। বাইরের দুনিয়া থেকে সরিয়ে রাখতে আনন্দ-উপভোগের আয়োজনের কমতি নেই।

যুবক সিদ্ধার্থ ও তার রাজঃসঙ্গী ছন্দক বিভিন্ন সময় প্রাসাদ পরিক্রমায় বের হন। পথে পথে ‘অশুভ’ বিনাশের নানা আয়োজন করা সত্ত্বেও একদিন এক বৃদ্ধের দেখা পান সিদ্ধার্থ। তিনি ছন্দকের কাছে জানতে চাইলেন মানুষটির অবস্থা সম্পর্কে। ছন্দক জানালেন, বৃদ্ধাবস্থায় মানুষের শক্তি কমে যায়, দৃষ্টি ক্ষীণ হয়, চামড়া ঝুলে পড়ে। প্রত্যেক মানুষই বয়স থাকা সাপেক্ষে একসময় বৃদ্ধ হয়, এটাই নিয়তি। আরেকদিন সিদ্ধার্থের চোখে পড়ল একজন অসুস্থ মানুষ। সেদিন তিনি জানলেন- রোগ, শোক মানুষকে কাবু করে। অন্য একদিন তাঁর সামনে পড়ল একদল শবযাত্রী। সেদিন তিনি জানলেন- লাশ হয়ে মানুষকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়।

সিদ্ধার্থের মনে প্রশ্ন জাগে- কেন মানুষ জন্ম নেয়? কেন রোগাক্রান্ত হয়? কেনই বা মারা যায়। উত্তর মেলে না। এভাবে একদিন দেখা পেলেন এক সন্ন্যাসীর। সন্ন্যাসীর পরনে স্বল্প-কম দামী বসন, দেহ কৃশকায়, কিন্তু চেহারায় চন্দ্রজ্যোতি; মনে হয়, সন্ন্যাসী দুঃখ, কষ্ট, জরা অতিক্রম করতে পেরেছেন। সত্যিই কি এসব অতিক্রম করা সম্ভব- এমন প্রশ্ন সিদ্ধার্থের মনে ঘুরপাক খায়। এসব নিয়ে আপন মনে তিনি ভাবতে থাকেন, কিন্তু সদুত্তরের দেখা নেই।

এদিকে সিদ্ধার্থের এমন কর্মকাণ্ড শুদ্ধধনের চোখ এড়ায় না। আট-দশজন বাবার মতো তিনিও ছেলেকে সংসারের জালে বাধতে সর্বশেষ উপায় খুঁজে পেলেন বিয়েতে। ধুমধাম করে একই রাজ্যের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি দন্ডপাণির কন্যা যশোধরার সাথে বিয়ে হলো সিদ্ধার্থের। সিদ্ধার্থও সংসারে বেশ ভাল আছেন, পুত্র রাহুল এলো পৃথিবীতে। কিন্তু মানবতার মুক্তির দায়িত্ব যে অজন্তেই কাঁধে তুলে নিয়েছে সংসারের মায়াজাল তাকে বাঁধতে পারে না।

এক আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাতে স্ত্রী, পুত্র, সংসার ছেড়ে ঊনত্রিশ বছর বয়সী সিদ্ধার্থ সন্ন্যাসব্রত নেয়ার উদ্দেশ্যে গৃহত্যগ করেন। রাতারাতি রাজপুত্র থেকে হয়ে গেলেন যোগী সন্ন্যাসী। ভিন রাজ্যে পাড়ি দিলেন, যাতে কেউ তাঁর খোঁজ না পায়। তিনি আলার কালাম নামে এক যোগীর কাছে ছয় বছর যোগসাধনা শিক্ষা করেন, ধ্যানী হওয়ার পথ খুঁজে পান, কিন্তু তার চিন্তা-চেতনা আরো বেশি কিছু খুঁজে ফেরে।

একসময় তিনি একাকী ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন, মগধ রাজ্যের উরুবিল্ব গ্রামে নীরঞ্জনা নদীর কাকচক্ষু জলের সামনে অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। সময় পরিক্রমায় তিনি লাভ করেন দিব্যজ্ঞান। যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি আত্মীয়, পরিজনসহ যাবতীয় আরাম-আয়েশ ছেড়েছেন, আজ সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেন।

সিদ্ধার্থ হয়ে উঠলেন বুদ্ধ। বুদ্ধ মানে পরমজ্ঞানী। তবে অবিরত ধ্যানমগ্ন থেকে তিনি হয়ে পড়লেন কৃশকায় ও কঙ্কালসার। ধ্যান ভেঙে নীরঞ্জনা নদীতে স্নান করে নিলেন, ভিক্ষার পাত্র হাতে মাধুকরী হলেন, ক্ষুধা নিবারণ করলেন। বুদ্ধ দুই অতিকে গ্রহণ করা অনুচিত বলে মত দিয়েছেন, এক হচ্ছে ইতর প্রাণীর মতো কামাচারে লিপ্ত হওয়া, দুই শারীরিক কৃচ্ছসাধন। তিনি মধ্যমার্গ বা মধ্যমপথে থাকতে উপদেশ দিতেন। তাঁর মতে, মধ্যমার্গের উপায় হচ্ছে আটটি কাজ, যেগুলোকে তিনি অষ্টমার্গ বলে বর্ণনা করেছেন। এগুলো হলো সৎ সংকল্প, সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ ব্যবহার, সৎ জীবনযাপন, সৎ চেষ্টা, সৎ দর্শন এবং সম্যক সমাধি।

ছত্রিশ বছর বয়সে সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভ করেন। তাঁর জীবনের পরবর্তী সময়গুলো তিনি ধ্যান, ধর্মোপদেশ দান, দর্শনের প্রচার, শিষ্যদের দীক্ষা, প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি কাজে ব্যয় করেন। তিনি সবসময় খালি পায়ে চলাফেরা করতেন, কোনো বাহন ব্যবহার করতেন না এবং একাহারি ছিলেন। বর্ষার তিন থেকে চার মাস বিহারে (ধর্ম ও দর্শন শিক্ষা কেন্দ্র) শিষ্যদের সাথে কাটাতেন। অন্য সময় পদব্রজে ধর্ম ও দর্শনের বাণী প্রচার করতেন শিষ্যদের নিয়ে। বুদ্ধের বাণী, উপদেশ, কথামালা পালি ভাষায় লিখিত ত্রিপিটকে সংরক্ষিত। পালিতে পিটক মানে সংগ্রহ। ত্রিপিটকের তিনভাগে বুদ্ধের নীতিসমূহ সংরক্ষিত আছে। এগুলো হলো বিনয়, সূত্র ও অভিধর্ম। বিনয়ে ভিক্ষুদের জন্য নীতি ও নির্দেশ, সূত্রে তাঁর উপদেশসমূহ এবং অভিধর্মে বুদ্ধের দর্শন বিষয়ক আলোচনা রয়েছে।

Image Courtesy: Daily Cox’s Bazar News

একসময় সিদ্ধার্থ দুঃখমুক্তির পথ খুঁজে পেলেন। তিনি এই পথের নাম দিলেন নির্বাণ। এখন আর তিনি সিদ্ধার্থ নন, তিনি এখন গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধ দুঃখের হেতু হিসেবে বর্ণনা করেছেন তৃষ্ণাকে। কোনো কিছু পাওয়ার ইচ্ছা হলো তৃষ্ণা। তিনি তিন রকম তৃষ্ণার কথা বলেছেন- কাম তৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা ও বৈভব তৃষ্ণা। সবরকম তৃষ্ণাকে অতিক্রম করতে পারলে নির্বাণ লাভ করা সম্ভব।

পঁয়তাল্লিশ বছর পর্যন্ত বুদ্ধ তাঁর দর্শন প্রচার করেন। জন্মস্থান লুম্বিনীর শালবনে বৈশাখী পূর্ণিমার তিথিতে আশি বছর বয়সে ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেহত্যাগ করে তিনি চিরনির্বাণ লাভ করেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
All rights reserved © 2025
Design By Raytahost